মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৫

ঐতিহ্যে এগিয়ে, প্রযুক্তিতে পিছিয়ে হেমনগর শশীমুখী উচ্চ বিদ্যালয়


মো. রুবেল আহমেদ, 

উনিশ শতকের শেষ প্রহরে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ইতিহাসে শিক্ষার আলো জ্বেলে ওঠে এক নতুন নাম হেমনগর শশীমুখী হাই ইংলিশ স্কুল। জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয় গোপালপুরের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আজও ঐতিহ্যের গৌরব বয়ে চলছে। শত বছরের পুরনো এই বিদ্যালয়ে নেই কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞানাগার বা লাইব্রেরি। তবুও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অধ্যবসায়ে প্রতিষ্ঠানটি আজও ভালো ফলাফল ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।



স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পুখুরিয়া পরগণার প্রভাবশালী জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৮৯০ সালে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার শিমলাপাড়া মৌজায় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীতে একটি বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা বর্তমানে হেমনগর রাজবাড়ী নামে পরিচিত। রাজবাড়ীর চারপাশে রয়েছে সাতটি পুকুর।

স্থানীয়দের অনুরোধে তিনি তাঁর নিঃসন্তান সৎ মা শশীমুখী দেবীর নামে রাজবাড়ীর পূর্ব পাশের পুকুরপাড়ে ১৯০০ সালে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠা করেন হেমনগর শশীমুখী হাই ইংলিশ স্কুল।

এটি গোপালপুর উপজেলার প্রথম স্কুল এবং তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছিল। বর্তমানে এটি হেমনগর শশীমুখী উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠার সময় বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন গিরিশ চন্দ্র সেন।



১৯০০ সালে বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শুরু হলেও, ১৯১৫ সালে চালু হয় ৮ম শ্রেণি (মাইনর)। দেশভাগের কয়েক বছর আগে মেট্রিকুলেশন ব্যবস্থা শুরু হয়। সে সময় স্থানীয়দের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কম থাকায় বিদ্যালয়টি বাংলা মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়।

বিদ্যালয়টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কলকাতা বোর্ডের অধীনে ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষা দিতে যেতে হতো জামালপুরে, আর পাকিস্তান আমলে সিরাজগঞ্জে।

‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে—১৯০৪ সালে হেমনগর হাই স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ২০১ জন, আর তখন গোপালপুরে ইংরেজি জানা লোকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬৯৯।

স্থানীয় বাসিন্দা সরকার মাজহারুল ইসলাম মিলন জানান, জমিদারের দুই মেয়ের জামাই বাদল চন্দ্র মুখার্জি ও হরিদল চন্দ্র মুখার্জিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে জ্ঞানী শিক্ষক এনে বিদ্যালয় পরিচালনা করা হতো। তখন হেমনগর ছিল এক প্রকার স্টেট, কলকাতার মানের শিক্ষাদান হতো এখানে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদ্যালয়ের বহু গুরুত্বপূর্ণ দলিল নষ্ট হয়ে যায়। পরে ২৯টি কাঠের আলমারিতে সংরক্ষিত নথিপত্র উলু পোকার আক্রমণে বিনষ্ট হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের অভাব রয়েছে; কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞানাগার ও লাইব্রেরি স্থাপন অত্যন্ত জরুরি।

বিদ্যালয়ের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন বা এখনো কর্মরত আছেন।

বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম মিঞা বলেন, বর্তমানে বিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ ১৮.১৩ একর। এখানে ৮০০+ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। শ্রেণিকক্ষ বাড়ানো এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর উপজেলার মধ্যে সেরা ফলাফল করে আসছে।

এখানে কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞানাগার স্থাপন করা জরুরি।

তিনি জানান, ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ৭৭ জনের মধ্যে ৫৮ জন পাস করেছে এবং ৬ জন পেয়েছে এ-প্লাস। কারিগরি বিভাগে ১৫৯ জনের মধ্যে ১৪১ জন পাস করেছে, এর মধ্যে ১২ জন পেয়েছে এ-প্লাস।

হেমনগর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি গোলাম রোজ তালুকদার ভিপি বলেন, জমিদার বংশধরেরা একসময় ইন্টারমিডিয়েট চালুর প্রতিশ্রুতি দিলেও দেশভাগের পর তারা কলকাতায় চলে যান। বিগত সরকারের অবহেলার কারণে বিদ্যালয়টি অবকাঠামোগতভাবে পিছিয়ে পড়েছে। 

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, হেমচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন মধুপুর উপজেলার আমবাড়ীয়া জমিদার পরিবারের উত্তরসূরি। তাঁর দাদা পদ্মলোচন রায় ব্রিটিশ সূর্যাস্ত আইনের মাধ্যমে আমবাড়ীয়ার জমিদারি লাভ করেন। ১৮৮০ সালে হেমচন্দ্র চৌধুরী সেই জমিদারি স্থানান্তর করেন সুবর্ণখালিতে (বর্তমান গোপালপুরের সোনামুখী বাজার সংলগ্ন)। সেটি যমুনায় বিলীন হলে ১৮৯০ সালে তিনি শিমলাপাড়া মৌজায় দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এরপর গ্রামের নামকরণ করা হয় হেমনগর। যা আজও “হেমনগর রাজবাড়ী” নামে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। 


SHARE THIS

Author:

সঠিক তথ্য পেতে সবসময় সমাবেশ ডটকমের সাথে থাকুন।

0 মন্তব্য(গুলি):